রূপ বাড়লেও গুণ কমেছে চারঘাটের খেজুরের গুড়ের
আব্দুল মতিন ,চারঘাট:
প্রতিবছরের মতো এবারও শীতে খেজুরের গুড় দিয়ে পিঠা বানিয়েছেন রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার মিয়াপুর গ্রামের গৃহবধূ সাবিনা ইয়াসমিন। তবে তাঁর পিঠা আগের মতো হয়নি। তিনি বলেন, ‘আগে খেজুরের গুড়ের ঘ্রাণে মন ভরে যেত। পিঠা-পায়েস খেয়ে সবাই প্রশংসা করতেন। এখন গুড়ে আগের স্বাদ-গন্ধ নেই। এই গুড়ের পিঠাও ভালো হয় না।’
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, চারঘাটের খেজুরের গুড়ের ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। মান ভালো হওয়ায় ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকার পাইকারেরা স্থানীয় মোকাম থেকে গুড় কিনে নিয়ে যান। তবে গুড়ে আগের মতো আর স্বাদ-গন্ধ নেই। সাধরণত খেজুরের গুড় একটু গাঢ় রঙেরই হয়ে থাকে। একটু কালচে। এই কালোর জন্য নাকি ইদানীং কালো গুড়ের চাহিদাই কমে গেছে। লোকে চায় ফরসা উজ্জ্বল রং। এজন্য বাড়তি লাভের আশায় কৃষক পর্যায়ে অনেকেই এভাবে চিনি মিশিয়ে গুড় তৈরি করছেন। আবার অনেকে ‘কারখানায়’ চিনি মিশিয়ে গুড় উৎপাদন করে বিক্রি করছেন। চিনির সঙ্গে রং,আটা, হাইড্রোজ, সোডা, ফিটকিরি প্রভৃতি রাসায়নিক মেশানোরও অভিযোগ উঠেছে।
ভেজাল গুড় তৈরি করায় গত বছর অভিযান চালিয়ে দুই ব্যক্তিকে জরিমানা করা হয়েছিল। এরপর ভেজাল গুড়ের ব্যবসায়ীরা গা ঢাকা দেন। এ বছর ফের তাঁরা সক্রিয় হয়ে উঠেছেন।
উপজেলার গুড় বাঁকড়া,নন্দনগাছী ও পার্শ্ববর্তী বানেশ্বর মোকামে বিক্রি হয়। সম্প্রতি বাঁকড়া বাজারে গিয়ে দেখা যায়, প্রতি কেজি খেজুরের গুড় ৮০-৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের গুড়ের (ঝোলাগুড়) কেজি ৬০ টাকা। স্থানীয় মহাজন ও দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা পাইকারেরা গুড় দেখছেন। পাশাপাশি সাধারণ মানুষও গুড় কিনছেন।
হাটে গুড় বিক্রি করতে এসেছেন গওরা গ্রামের রওশন আলী, খবির প্রামাণিক ও কোরবান আলী। তাঁরা বলেন, প্রতিটি গাছের জন্য মালিককে মৌসুমে ২০০-৩০০ টাকা দিতে হয়। মজুরি, জ্বালানি খরচসহ প্রতি কেজি খাঁটি গুড়ের উৎপাদন খরচ পড়ে গড়ে ১০০ টাকা। কিন্তু বাজারে এত দামে গুড় বিক্রি হয় না।
তাঁরা আরও বলেন, প্রতি ১০ লিটার খেজুরের রসে ১ কেজি গুড় পাওয়া যায়। তবে ১০ লিটার রসের সঙ্গে ২ কেজি চিনি মেশালে অন্তত ৫ কেজি গুড় উৎপাদন হয়। বাজারে প্রতি কেজি চিনি ৬০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। বাড়তি মুনাফার জন্য অনেকেই এভাবে গুড় তৈরি করছেন।
পরানপুর থেকে আসা হাফিজ উদ্দিন বলেন, গ্রামে গুড়ে শুধু অল্পচিনি মেশানো হয়। কিন্তু চারঘাট বাজারের আশে পাশের এলাকায় কয়েকজন কারখানা খুলে হাজার হাজার মণ ভেজাল গুড় তৈরি করছেন। বাজার থেকে কম দামে নিম্নমানের গুড় কিনে এসব কারখানায় নিয়ে তার সঙ্গে চিনি ও রাসায়নিক মেশানো হচ্ছে।
ঢাকা থেকে আসা পাইকার হানিফ আলীর মতে, প্রান্তিক কৃষক ও মহাজন সবাই ভেজাল গুড় তৈরি করছেন। গুড়ের রং সাদা ও শক্ত করতে তাঁরা যথেচ্ছভাবে চিনির সঙ্গে ক্ষতিকারক রাসায়নিক মেশাচ্ছেন।রাসায়নিক আর চিনির প্রভাবে খেজুরের গুড়ের রং ফরসা হয়েছে বটে, তবে তার আসল স্বাদ আর নেই। হয়তো এটাই এ যুগের রেওয়াজ—গুণের চেয়ে রূপের কদর বেশি। ফলে রূপের জেল্লা বাড়লেও গুণে খর্ব হয়েছে চারঘাটের শীতের খেজুরের গুড়।
চারঘাট উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুহাম্মদ নাজমুল হক বলেন,এখানকার খেজুরের গুড়ের সুনাম দীর্ঘদিনের।এ জন্য আমরা মৌসুমের শুরু থেকে প্রতিটি গ্রামে মাইকিং করে ভেজাল গুড় তৈরি ও বিক্রি করতে সতর্ক করা করেছি।এ বিষয়ে অভিযান চলমান আছে বলে জানান তিনি।
No comments