বাল্যবিবাহ বন্ধে আনোয়ারের লাল বাইসাইকেলে প্রচারাভিযান এখন চারঘাটে
আব্দুল মতিন, চারঘাট:
আনোয়ার হোসেন তালুকদার। পেশায় একজন কাঠমিস্ত্রি। বয়স ৫০ এর কোঠায়। তবে মনে তাঁর দৃঢ় প্রত্যয়। বাল্যবিবাহ বন্ধে সোচ্চার। এ বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে লাল রঙের বাইসাইকেলে এবং লাল রঙের পোষাকে ৬৪ জেলায় ছুটে গেছেন তিনি। এবার শুরু করেছেন দেশের সকল উপজেলায় প্রচারনা। ইতিমধ্যে ২১৯ তম উপজেলা হিসেবে রাজশাহীর চারঘাট উপজেলায় পৌছায় ২৭শে ডিসেম্বর (শুক্রবার) সন্ধায়।
এখানে এসেই প্রথমে উপজেলার বিভিন্ন অলিগলি মাড়িয়ে রাতে থানাপাড়া সোয়ালোজ এ রাত্রিযাপন করেন। এরপর দিনের বেলা পুরো উপজেলা ঘুরে বাঘা উপজেলার উদ্দ্যেশে রওনা দেবেন আনোয়ার। তার এ সাক্লিং এর সময়ে রাস্তায় কোথাও কোন স্কুল পেলে সে সাইকেল থামিয়ে ওই স্কুলের শিক্ষার্থীদের বোঝান বাল্যবিবাহের কুফল এবং পথচারীদের হাতে বাল্য বিবাহের কুফল নিয়ে নানা শ্লোগানের লিফলেট বিতরণ করেন।
ব্যক্তি উদ্যোগে ‘বাল্য বিয়েমুক্ত বাংলাদেশ’ প্রচারে নামা উদ্যমী আনোয়ার হোসেনের বাড়ি বগুড়ার সদর উপজেলার বারপুর গ্রামের উত্তরপাড়ায়। ২০১৫ সালের ১৫ জানুয়ারী তিনি বাল্যবিবাহ বিরোধী প্রচারাভিযানে বের হয়েছিলেন লাল সাইকেলে চড়ে। ৬৭ দিনে শেষ করেছেন ৬৪ জেলা ভ্রমন। এ সময় তাঁর পরনে ছিল লাল পায়জামা, লাল জামা ও সোয়েটার। পায়ে ছিল লাল জুতা। সাইকেলের সামনের দিকে বাঁধা ছিল দুটি জাতীয় পতাকা ও একটি লাল পতাকা। বাইসাইকেলটিও ছিল লাল।
আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘রাস্তাঘাটে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, আমার সবকিছু এমন লাল কেন। জবাবে বলেছি, বাল্যবিয়ে পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র সবার জন্যই বিপজ্জনক। লাল পোশাক-সাইকেল-পতাকার মাধ্যমে আমি বোঝাতে চেয়েছি, বাল্যবিয়ে আসলেই বিপজ্জনক।’
অভাব-অনটনের কারণে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন আনোয়ার হোসেন। এরপর কাজ নেন বগুড়া শহরের একটি রেস্তোরাঁয়। দুই বছর পর চলে যান চট্টগ্রামে। সেখানে আগ্রাবাদ এলাকায় একটি আসবাবের দোকানে কাজ নেন। পরে বিয়ে করেন চট্টগ্রামের কদমতলী এলাকায়। থাকতেন পাঠানটুলি রোডে। সেখানে থাকতেই তাঁর স্কুলপড়ুয়া দুই ভাগনির বিয়ে হয়ে যায়। তখন ওদের বয়স ছিল যথাক্রমে ১৪ ও ১৫ বছর। পরে দুই বোনই স্বামী পরিত্যক্ত হয়ে ঢাকায় পোশাক কারখানায় চাকরি নেয়।
আনোয়ার বলেন, বাল্যবিবাহের শিকার দুই ভাগনির এমন করুণ পরিণতি তাঁকে পীড়া দেয়। এরপর থেকে খবরের কাগজে বাল্যবিবাহের সংবাদ দেখলেই খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তেন। সংগ্রহ করতেন। বাল্যবিবাহ বন্ধে কিছু একটা করার কথা ভাবতেন।
তিনি বলেন, দুই যুগ পর চট্টগ্রাম ছেড়ে তিনি কুমিল্লার দাউদকান্দি যান। সেখানে আসবাবের দোকান দেন। সেখানেও বাল্যবিবাহের নানা ঘটনা ঘটতে দেখেন। তাঁর মন খারাপ হয়। এরপর সিদ্ধান্ত নেন সাইকেলে ঘুরে ঘুরে বাল্যবিবাহ বিরোধী প্রচার চালাবেন। দোকান বিক্রি করে পুরোনো একটি সাইকেল কেনেন। কিছু প্রচারপত্রও ছাপান। প্রথমে ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে সেই সাইকেলে চেপে বেরিয়ে পড়েন। কুমিল্লা, ফেনী ও চট্টগ্রাম শহর ঘুরে মানুষের হাতে তুলে দেন বাল্যবিবাহ বিরোধী প্রচারপত্র।
এরপর কিছু প্রচারপত্র আর বাল্যবিবাহ-সংক্রান্ত সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনের ফটোকপি নিয়ে ২০১৫ সালে ১৫ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিক ভাবে বগুড়া থেকে বাল্যবিবাহ বিরোধী সাইকেলযাত্রা শুরু করেন। এরপর ৬৭ দিনে তিনি ৬৪টি জেলায় প্রচার চালান। এই সময়ের মধ্যে জেলা প্রশাসকসহ বিশিষ্টজনদের কাছ থেকে লিখিত মন্তব্য সংগ্রহ করেন।
আনোয়ার হোসেন জানায়, তার এ সাইক্লিং এর জন্য তার ব্যবসা বিক্রি করে দিয়েছে। কিন্তু আজো কোন সরকারী বা বেসরকারী সহযোগীতা পায়নি। তবে তিনি কোন সহযোগীতা পেলে। ভবিষ্যতে দেশের বিভিন্ন ইউনিয়ন পর্যায়ে এ অভিযান পরিচালনার চিন্তা রয়েছে।
No comments