‘গাছে দুলছে স্বপ্ন,বাজারজাত নিয়ে দুঃচিন্তায় চাষী-ব্যবসায়ী’
আব্দুল হামিদ মিঞা, বাঘা ঃ
বিগত বছরগুলোর মতো এবারও বাগানের গাছে গাছে ঝুলছে আম। আগামজাতের আমও গাছে পাঁকতে শুরু করেছে। প্রশাসনের বেধে দেওয়া সময়ের মধ্যে পর্যায়ক্রমে গাছ থেকে আম নামানো হবে। কিন্তু দুঃচিন্তা বাড়ছে রাজশাহীর বাঘা-চারঘাটের প্রধান অর্থকরী ফসল আমের বাজারজাত নিয়ে। বহু মানুষের জীবন ও জীবিকা নির্ভরশীল আমের এই সময়ে দৌড়ঝাপ শুরু হয় হাজার হাজার মানুষের। বাজার এলাকার রাস্তাগুলো ট্রাক, ভ্যান আর মোটরসাইকেলে ঠাসা থাকে। বাগানমালিক, ব্যাপারী, খুচরা ব্যবসায়ীসহ আমের সঙ্গে যুক্ত লাখো মানুষের দম ফেলার ফুরসতটুকুও মিলত না এ সময়। বাগান হাতবদল হয়ে লেনদেন হতো কোটি কোটি টাকার। কিন্তু এ বছর সব পাল্টে দিয়েছে করোনাভাইরাস। বিপুল আর্থিক ক্ষতির শঙ্কায় পড়েছেন, রাজশাহীর বাঘা-চারঘাটের আম চাষী, মৌসুমি বাগান ব্যবসায়ী, চালানি কারবারি, শ্রমিক থেকে আড়তদার সবাই।
বাগান ঘুরে দেখা গেছে, বিগত বছরগুলোর মতো এবারও বাগানের গাছে গাছে ঝুলছে আম। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও নেই শুধু বিগত বছরগুলোর মতো ক্রেতা-বিক্রেতাদের সেই দৌড়ঝাপ। হাটবাজারগুলো এখনো সুনসান। স্থানীয় কিছু ছোট ব্যবসায়ী মাঠে আছেন। তাঁরা গতবারের চেয়ে পাঁচ থেকে ছয় গুণ কম দাম বলছেন। করোনার প্রকোপে আম চাষীদের সেই স্বপ্ন এবার ফিকে হয়ে গেছে।
বাগান মালিক, আম চাষী, চালানি ব্যবসায়ী, মোকামের আড়তদার ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী ১৫ মে থেকে রাজশাহী অঞ্চলের গুটি জাতীয় দেশি আম নামানোর সময়সূচি ঘোষণা করেছে স্থানীয় জেলা প্রশাসন। সময় সূচি অনুযায়ী, সব ধরনের গুটি জাতের আম ১৫ মে, গোপালভোগ ২০ মে, লক্ষণভোগ ও রানীপসন্দ ২৫ মে, ক্ষিরসাপাত বা হিমসাগর ২৮ মে, ল্যাংড়া ৬ জুন, আম্রপালি ও ফজলি ১৫ জুন, আশ্বিনা ও বারি-৪ জাতের আম ১০ জুলাই গাছ থেকে পেড়ে বিক্রি ও চালান করা যাবে।
কিন্তু এখন পর্যন্ত রাজশাহী অঞ্চলের বড় বড় আমের মোকামে আম কেনাবেচা ও চালানের কোনো প্রস্তুতি নেই। কারণ এখন পর্যন্ত চালানি ব্যাপারিদের কোনো দেখা নেই। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা তিন লাখ টাকার বাগানের দাম বলছেন ৫০-৬০ হাজার টাকা। আম পেকে গেলেও ক্রেতার অভাবে বাজারে নিতে পারবেন কিনা তা নিয়েই শঙ্কায় ভুগছেন। এবার আম বিক্রি করে পরিচর্যার খরচ তোলা যাবে কি না, এ নিয়েও সন্দেহ রয়েছে।
উপজেলা কৃষি স¤প্রসারণ বিভাগ জানিয়েছে, রাজশাহীর সবচেয়ে বেশি আমবাগান রয়েছে বাঘা-চারঘাট উপজেলায়। এ দুই উপজেলায় কয়েককোটি টাকার আমের ব্যবসা হয় বছরে। ঘন ঘন বৃষ্টির কারণে রোগবালাইমুক্ত আম হয়েছে পুষ্টও বড়। ফলে আমের মোট ফলন প্রাক্কলনের চেয়ে কিছু বেশি হবে। বাঘায় ৮হাজার ৩৭০ হেক্টর জমিতে আমবাগান রয়েছে। উৎপাদন ধরা হয়েছে ৯৪ হাজার ১৬২ দশমিক ৫ মেট্রিক টন। চারঘাটে আমবাগান রয়েছে ৩হাজার৮১২ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন ধরা হয়েছে ৪৮ হাজার ৭১২ দশমিক৫ মেট্রিক টন।
ব্যবসায়ী সেকেন্দার আলী জানান, ছোট বড় মিলে আড়ৎ রয়েছে প্রায় আড়াই শতাধিক। এসব আড়ৎ থেকে আম চালান হয় ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট, বরিশালও খুলনা অঞ্চলের বিভিন্ন মোকামে। আম চালানে সমস্যা হলে চাষী ছাড়াও মৌসুমি বাগান ব্যবসায়ীরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। বেকার হয়ে পড়বেন শ্রমিকরাও। বাঘা উপজেলার আড়পাড়া গ্রামের আমচাষি ও ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন বলেন, প্রতিবছর ঢাকার ব্যবসায়ীরা তাদের আড়তে আম দেওয়ার শর্তে স্থানীয় আম ব্যবসায়ীদের শত শত কোটি টাকা দাদন (সুদবিহীন ঋণ) দিতেন। এবার তাঁরা দাদন তো দেনইনি, গতবারের আমের দামও দেননি।
রপ্তানিকারক সমিতির সঙ্গে চুক্তি করে রাজশাহীর বাঘা থেকে সরাসরি ইউরোপের বাজারে আম পাঠায় সাদী এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। গত বছর প্রতিষ্ঠানটি নিজের বাগানের ও কেনা মিলিয়ে প্রায় দুই হাজার মেঃ টন আম বিক্রি করেছে। বিদেশে পাঠিয়েছে ৩৬ টন আম। প্রতিষ্ঠানটির মালিক শফিকুল ইসলাম বলেন, এখন পর্যন্ত দেশি-বিদেশি কোনো ক্রেতাই তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। প্রতিবছর এত দিনে ক্রেতারা হুমড়ি খেয়ে পড়তেন। আম বেচাকেনা নিয়ে একই রকম হতাশার কথা বলেছেন আলাইপুর গ্রামের আম ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, অন্য বছর ব্যবসায়ীরা আম কিনতে যেভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়তেন, এ বছর তার ছিটেফোঁটাও নেই। ব্যবসায়ীরা যোগাযোগই করছেন না। আম কোথায় বিক্রি করবেন,তা নিয়ে দুঃচিন্তায় পড়েছেন।
বাঘা উপজেলা কৃষি অফিসার শফিউল্লাহ সুলতান জানান, এবারও কন্টাক্ট ফার্মিংয়ের আওতায় এই চাষিদের আম পরিচর্যায় কৃষি বিভাগ থেকে বিশেষ নজরদারি করা হয়েছে। করোনার কারণে সম্ভাব্য বিপুল আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কার কথা জেলা প্রশাসনকে জানানো হয়েছে। আম চালানের বিষয়ে দ্রæত কি পদক্ষেপ নেয়া যায় তা নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে আলোচনা চলছে। একটা সমাধান আসবে। আশা করি, সময়ের মধ্যে অনেক কিছুই স্বাভাবিক হয়ে আসবে। আমের বাজার পাওয়া যাবে। উপজেলা নির্বাহি াফিসার শাহিন রেজা বলেন, আমে রাসায়নিকের ব্যবহার ঠেকাতে এবং অসময়ে আম পাড়া বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত এবং পুলিশ কঠোরভাবে নজরদারি করবে।##
No comments