রাসিকের তিন হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন, ছয় মাসেই উঠে যাচ্ছে রাস্তার কার্পেটিং!
![]() |
ছয় মাসেই উঠে যাচ্ছে রাস্তার কার্পেটিং! |
নিজস্ব প্রতিবেদক:
রাজশাহী মহানগরীর সমন্বিত নগর অবকাঠামো প্রকল্পের আওতায় ৩০টি ওয়ার্ডে উন্নয়নকাজ চলমান রয়েছে। এরই অরেক রাস্তা ও ড্রেন নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। তিন বছর মেয়াদী এ উন্নয়ন প্রকল্পের মেয়াদ গত জুনে শেষ হয়েছে। এরই মধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বৃদ্ধির জন্য প্রস্তবনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তবে এখনো অধিকাংশ কাজ বাকিই রয়েছে। কিন্তু যেসব রাস্তার কাজ এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে, সেগুলোর ওপরের অংশের পিচঢালা পাথর উঠে যাচ্ছে। এতে করে নিম্নমাণের নির্মাণসামগ্রি ব্যবহার ও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে এ উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে।
অভিযোগ আছে, প্রতিটি উন্নয়ন কাজে রাসিকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা আগে ২০-২৫ ভাগ পর্যন্ত কমিশন আদায় করতেন। এর বাইরে প্রকৌশলীরা নেন ৩-৫ পার্সন্টে কমিশন। এতে কাজের মাণ আরও খারাপ হচ্ছে। তবে বিভাগীয় কমিশনার প্রশাসকের দায়িত্ব নেওয়ার পরে এখন অনেকটায় পরিস্থিতি ভালো হয়েছে বলেও দাবি করেন অনেকেই। কিন্তু প্রকৌশলী দপ্তরের কমিশন থামেনি এখনো।
স্থানীয়রা বলছেন, যেসব রাস্তা নিমার্ণ বা সংস্কার করা হয়েছে সেসব রাস্তায় অধিকাংশ ইটের খোয়া ব্যবহার করা হয়েছে বাড়ি ভাঙ্গা পুরনো ইটের। আবার ওপরের অংশে যে পরিমাণ বিটুমিন ও পাথর দিয়ে কার্পেটিং করার কথা ছিল, সেখানেও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ফলে ছয় মাস না যেতেই ওয়ার্ড পর্যায়ের ওইসব রাস্তাগুলোর কার্পেটিং উঠে যাচ্ছে। সরেজমিন রাজশাহী নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। আর নিয়ে ব্যাপক ক্ষোভও ছড়িয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের মাঝে।
স্থানীয় এলাকাবাসীর দাবি, ড্রেন, ফুটপাত ও রাস্তা নির্মাণ বা সংস্কারের সময় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঠিকাদাররা ব্যাপক অনিয়ম করেছেন। এলাকাবাসীর পক্ষে নগর কর্তৃপক্ষ ও রাসিকের প্রকৌশলীদেরকে ফোন করে বার বার অভিযোগও করা হয়েছে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। উল্টো ঠিকাদাররা ইচ্ছামতো কাজ করে গেছেন দাপটের সঙ্গে। কারণ সমস্ত কাজেরই দেখভাল করেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। ফলে তাদের দাপটে ঠিকাদাররা দায়সারা কাজ করে সরকারি অর্থ লোপাটের মহোৎসবে নেমেছিলেন।
নগরীর বিলসিমলা এলাকার সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘রাজশাহী বিভাগীয় স্টেডিয়ামের পাশ দিয়ে যাওয়া রাস্তাটি মাত্র মাস দুয়েক আগে নির্মাণকাজ শেষ করেছে ঠিকাদার। ওইসময় রাস্তায় যেসব খোয়া ফেলানো হয়েছিল, তার অধিকাংশই ছিলো বাড়ি বা রাস্তার পুরনো ইটের খোয়া। আবার এক ইঞ্চিও পাথর দেওয়া হয়নি কার্পেটিংয়ের সময়। বিটুমিনের পরিমাণও ছিল নামেমাত্র। ফলে তিন মাসও গেলো না রাস্তাটি। এরই মধ্যে কার্পেটিং উঠতে শুরু করেছে। হয়তো আর মাস ছয়েকের মধ্যে আবার খানা-খন্দে ভরে যাবে।’
তিনি বলেন, রাস্তাটি নির্মাণের সময় রাসিকের প্রকৌশলীদের বার বার অভিযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। তারা এসে উল্টো আরও টাকা-পয়সা খেয়ে চলে যায় মনে হয়েছে। না হলে এই কাজ এতো নিম্নমাণের হওয়ার কথা না।
একই অভিযোগ করেন নগরীর কয়েরদাঁড়া এলাকার আব্দুর ওয়াহব। তিনি বলেন, এই এলাকার ভিতর দিয়ে যাওয়া রাস্তাটির সংস্কারকাজ শেষ করা হয়েছে। কিন্তু এখুনোই কার্পেটিং উঠে যাচ্ছে। কাজ তো ভালোভাবে করিনি। সরকারি অর্থ লুট করেছে।’
নগরীর তেরোখাদিয়া এলাকার নাজিম উদ্দিন বলেন, এই এলাকায় বর্ষায় জলাবদ্ধতা লেগেই থাকে। যে ডেন নির্মাণ করা হয়েছে সেটি কোনোই কাজে আসছে না। আবার ড্রেন নির্মাণের সময় নিম্নমাণের সামগ্রি ব্যবহার করা হয়েছে। লোহার রডগুলোও ঠিকমতো ব্যবহার হয়নি।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নগরীর ৫ নম্বর ওয়ার্ডে ৬ কোটি ৮০ লাখ টাকার উন্নয়ন প্যাকেজের আওতায় মহিষবাথান ঈদগাহ থেকে হড়গ্রাম বাজার ও কারিতাস মোড় থেকে রাজপাড়া মোড় পর্যন্ত ১ দশমিক ৩ কিলোমিটার গড়ে ৪ মিটার প্রশস্ত রাস্তাটি সংস্কার হয়। কিন্তু দুটি রাস্তারই এরই মধ্যে কার্পেটিং উঠতে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় হাবিবুর রহমান নামের এক ব্যক্তি।
রাসিকের দেওয়া তথ্যমতে, সমন্বিত নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের অধীন তিনটি প্যাকেজে ৮টি ওভারপাস বা ফ্লাইওভার ও ১৯টি ছোট-বড় অবকাঠামো নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। এছাড়াও চলমান রয়েছে, ৮৯ কোটি ৭৪ লাখ টাকা ব্যয়ে নগরীর হড়গ্রাম নতুনপাড়া লেভেল ক্রসিংয়ে ও ওভারপাস নির্মাণকাজ, ১১৮ কোটি ৬৯ লাখ টাকাব্যয়ে কোর্ট স্টেশন রেলওয়ে ক্রসিংয়ে ৫২১ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১২ মিটার প্রস্থ ওভারপাস, ২০৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকা ব্যয়ে শহিদ কামারুজ্জামান চত্বর লেভেল ক্রসিংয়ে ৮৯৭ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১২ মিটার প্রস্থ ওভারপাস নির্মাণ, ১১৩ কোটি ৪৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ভদ্রা লেভেল ক্রসিংয়ে ৫২০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১২ মিটার প্রস্থ ওভারপাস নির্মাণ, ২৯১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ব্যয়ে বন্ধ গেট এবং নতুন বিলসিমলা লেভেল ক্রসিং পর্যন্ত ১ হাজার ২৫৫ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১২ মিটার প্রস্থ সমন্বিত ওভারপাস নির্মাণকাজ। এরই মধ্যে প্রকল্পগুলোর ২০-০০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তবে এসব কাজেও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
রাসিক সূত্র মতে, একই প্রকল্পের আওতায় ১৮২ কোটি টাকা ব্যয়ে রাজশাহী মহানগরীর রাজশাহী-নওগাঁ প্রধান সড়ক থেকে মোহনপুর-রাজশাহী-নাটোর সড়ক পর্যন্ত পূর্ব-পশ্চিম সংযোগ সড়ক নির্মাণ, ১৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে রাজশাহী মহানগরীর জলাবদ্ধতা দূরীকরণে নর্দমা নির্মাণ, ১২৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নগরীর কল্পনা সিনেমা হল থেকে তালাইমারি মোড় পর্যন্ত সড়ক প্রশস্তকরণ ও উন্নয়ন, ১৭২ কোটি টাকা ব্যয়ে রাজশাহী মহানগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার উন্নয়ন এবং ৪৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডে সড়ক ও নর্দমাসমূহের উন্নয়ন।
রাসিক সূত্র আরও জানায়, নতুন এই প্রকল্পের মাধ্যমে সিটি কর্পোরেশনে অযান্ত্রিক যানবাহন লেনসহ চারলেন সড়ক নির্মাণ করা রয়েছে ১৩ দশমিক ১০ কিলোমিটার, কার্পেটিং সড়ক নির্মাণ ৩৬৮টি; কার্পেটিং সড়ক পুননির্মাণ ২৫৮টি, কার্পেটিং সড়ক প্রশস্তকরণ ৫৩টি, সিমেন্ট কনক্রিট সড়ক নির্মাণ এক হাজার ৮০৭টি, ফুটপাত নির্মাণ ৪১ দশমিক ৯২ কিলোমিটার, গোরস্থান ও জলাশয়ের পাশে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করার কথা রয়েছে ৬২ দশমিক সাত কিলোমিটার। জলাশয়সমূহে সৌন্দর্যবর্ধনমূলক কাঠামো নির্মাণ ১৯টি। গণশৌচাগার নির্ম ৩০টি, পার্ক নির্মাণ চারটি, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণ, ৮টি ফুটওভার ব্রিজ, বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ৫০টি, কাঁচাবাজার চারটিসহ জলাশয় খনন ও সড়ক আলোকায়নসহ ৬৯টি ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করার কথা রয়েছে।
এসব কাজের অধিকাংশই সম্পন্ন হয়েছে। তবে স্থানীয়রা বলছেন, এসব কাজেও ব্যাপক অনিয়ম করা হয়েছে। ফলে এরই মধ্যে রাস্তার ধারে ফুটপাতের টাইলসগুলো উঠে যাচ্ছে। ফুটপাতের স্লাব হারিয়ে গেছে। জনসাধারণের চলাচলও ঝুঁকিরমুখে পড়েছে। জলাসময়সমূহে সৌন্দর্যবর্দ্ধন করতে গিয়ে ছোট করে ফেলা হয়েছে পুকুরগুলো। আর পকেটে ভরেছে ঠিকাদার ও প্রকৌশলী এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের।
রাসিকের একটি সূত্র জানায়, প্রতিটি উন্নয়ন কাজে রাসিকের প্রকৌশলীরা অন্তত ৩-৫ পার্সন্টে কমিশন আদায় করেন। সরকারি প্রকল্পে অলিখিত দুই ভাগ কমিশন আদায় করেন প্রকৌশলীরা। সেখানে রাসিকের প্রকৌশলীরা আদায় করেন তিন ভাগ। এতে কাজের মাণ আরও খারাপ হচ্ছে। এর বাইরে রাসিকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা আদায় করতেন ২৫-২৫ ভাগ। সবমিলিয়ে রাসিকের উন্নয়ন কাজে অন্তত ২৫ ভাগ টাকা হত টেবিলে টেবিলে ভাগ-বাটোয়ারা। তবে এখন অনেকটা কমে গেছে। তবে এখনো বেপরোয়া প্রকৌশলীরা। তারা কমিশন ছাড়া কোনো বিল ছাড় করেন না বলে অভিযোগ করেছেন একাধিক ঠিকাদার।
উন্নয়নের নামে নিম্নমাণের কাজ ও অনিয়ম সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজশাহী রাসিকের ভারপ্রাপ্ত তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আহম্মদ আল মইন বলেন, আমি নতুন দায়িত্ব নিয়েছি। এসব নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারব না।’
রাসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড,এবিএম শরীফ উদ্দিন বলেন, ‘কোনো কাজে অনিয়ম হয়ে থাকলে, সেগুলো তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে কাউকেই এখন আর নিম্নমাণের কাজ করতে দেওয়া হবে না।’#
No comments